প্রকাশিত: Mon, Jul 1, 2024 3:13 PM
আপডেট: Tue, Apr 29, 2025 11:43 PM

সাম্প্রদায়িকতা আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে

ইমতিয়াজ মাহমুদ : [১] কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার টাকিমারা গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছে। মসজিদে মাইকিং করে চায়না বেগম নামে লালনভক্ত এক ৯০ বছর বয়সী বৃদ্ধার ঘর ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীর দাবি, প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারধরেরও শিকার হয়েছেন তিনি। এই ঘটনায় একটা মামলা হয়েছে সদর থানায়। একজন সাবেক ইউপি মেম্বারসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনসহ ৪৫/৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা সেই তথ্য আরটিভির ওয়েবসাইটে এই খবরটাতে বলা হয়নি। 

চায়না বেগম জানান, তার স্বামী আধ্যাত্মিক সাধক লালন সাঁইজির অনুসারী ছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলো স্বামীর কবরে মাথা ঠেকিয়ে কাটিয়ে দেবেন বলে ভেবেছিলেন তিনি। লালনভক্ত এ বৃদ্ধা বলেন, আমার স্বামী মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, কোথাও জায়গা না হলে তুমি আমার কবরের পাশেই থাকবা। প্রতিবছর বাতাসার সিন্নি হলেও করবা। তার কথা রাখতেই ঘরখানা তৈয়ার করি। কিন্তু এলাকার লোকজন আমাকে না জানিয়েই সব ভেঙে ফেলেছে। একজন বয়স্কা নারী, তাঁর নিজের জায়গাতে নিজের মৃত স্বামীক্যা কবর দিয়েছে, পাশে একটা ঘর বানিয়েছে, সেটা ওরা ভেঙে দিয়েছে। না, এখানে কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল না। এটা ঘটেছে গ্রামের সংখ্যাগুরু লোকজন, অর্থাৎ অর্থোডক্স মুসলমান লোকজন, ওরা মনে করেছে যে এই নারীর জীবনযাপন, তাঁর বাউলপন্থা অনুসরণ ইত্যাদি ওদের ধর্মের অনুমোদিত পথ নয়। সুতরাং তাকে এখান থেকে উৎখাত করতে হবে। এটা নতুন কোন ঘটনা নয়, এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে একদল মুসলমান মানুষ গিয়ে হামলা করে বাউলদের আখড়া ভেঙে দিয়েছে, বাউলকে আক্রমণ করেছে। আর এ তো কেবল আজকের ঘটনা নয়, আপনারা জানেন যে সুনাগঞ্জের বাউল, যাদের গান বাঙলার সীমানা ছাড়িয়ে সর্বত্র গাওয়া হয়, ওদের ঢলক দোতারা, সারিন্দা এইসব ভাঙা হয়েছে অতীতে।

[২] চায়না বেগমের ঘর ভাঙার ঘটনার হয়তো বিচার হবে।  তবে সম্ভাবনা আছে বিচার হয়তো কোনোদিনই হবে না। চায়না বেগমের বয়স নব্বই, তার ঘর হয়তো আবার তৈরি হবে, মৃত্যুর আগে হয়তো তাকে আর হেনস্থা হতে হবে না। কিন্তু চায়না বেগমের সাথে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা তো একটা লক্ষণ মাত্র, মূল ব্যাধি নয়। মূল ব্যাধি তো অনেক গভীর এবং অনেক ভয়াবহ। মূল ব্যাধিটি যদি আমরা চিহ্নিত না করি এবং নিরাময়ের চেষ্টা না করি তাইলে একদিন আমাদের এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিনষ্ট হবে। মূল সমস্যা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতা আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন গভীরভাবে বাসা বেঁধে আছে যে এটাকে দূর করাও এখন একটা কঠিন কাজ হয়ে গেছে। আমাদের দেশে সিপিবি এবং অন্য দুই একটা ছোট ছোট রাজনৈতিক দল ছাড়া প্রায় প্রতিটা রাজনৈতিক দল, গ্রুপ এবং ব্যক্তি কোনো না কোনোভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহ দেয় এবং সাম্প্রদায়িকতাকে নিজেদের রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসূচির সাথে অন্তর্ভুক্ত করে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে। আফসোসের কথা কি জানেন? আপনারা যাদের একসময় বামপন্থী হিসাবে জানতেন ওদের মধ্যেও একটা বড় অংশ সাম্প্রদায়িক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। 

একজন মানুষ ধর্ম বিশ্বাস বা ধর্মীয় আচরণের ধরন বা মত পথ আপনার পছন্দ নাও হতে পারে। আপনি মনে করতেই পারেন যে বাউল ধর্ম বা বাউল পন্থা ইসলাম ধর্মের সঠিক পথ নয়, বা এটা একটা ভুল পথ বা ভুল ধর্ম ইত্যাদি যেকোনো কিছু। কিন্তু একজন মানুষ যে তার নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় আচার আচরণ করতে পারে বা নাও করতে পারে এটা তো খুব জটিল কোনো ধারণা নয়। যেকোনো সভ্য সমাজের যেকোনো সুস্থ স্বাভাবিক নাগরিকই এটা জানে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অপরের জীবনযাপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ওরা তো অন্যায় করে- ওরা তস্কর, সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী।  [৩] আমাদের দেশে কিছু লোক আছে যারা দেশটাকে কেবলমাত্র মুসলমানের জন্যে একটি দেশ বানাতে চায়। এটা অন্যায়। এই দেশটা কেবল মুসলমানের দেশ নয়। এই দেশ তৈরিই হয়েছে একটি আধুনিক সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে। এইসব সাম্প্রদায়িক আচরণ যারা করে এরা যে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী ও বাংলাদেশের অস্তিত্বের শত্রু এই বিষয়ে কি আপনার কোনো দ্বিমত আছে? চায়না বেগমের জন্যে ন্যায় দাবি করি। যারা ওর ঘর ভেঙেছে ওদের প্রত্যেকের গ্রেপ্তার বিচার ও শাস্তি দাবি করি। দাবি করি বিচারটা যেন দ্রুত হয়, আর এক্ষুণি যেন তস্করগুলিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর আপনাদের সকলের প্রতি আহ্বান জানানইÑ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা তীব্রতর করে তুলুন। ‘আমরা এখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছি। সুতরাং সাম্প্রয়াদ্যিক্তয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না’ এইরকম ফালতু কথা বলবেন না। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই একটা অংশ মাত্র। এই দুই লড়াইই একসাথে করতে হয়। নাইলে আপনি এক অপশক্তিকে তাড়াতে গিয়ে আরেক অপশক্তির হাতে দেশকে তুলে দিবেন। লেখক: আইনজীবী। ২৯-৬-২০২৪। ফেসবুক থেকে